নিজস্ব প্রতিবেদক
‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়’ পুঁথিগত এ সহজ কথাটি সহজে বলা গেলেও, বাস্তবতার নিরিখে তা যে সহজ নয়, সেকথা স্বীকার করার মতো মানুষেরও অভাব মেলেনা নিশ্চয়ই। তাই বলে মনের ইচ্ছে-পাখির ডানা মেলে আকাশে উড়া যার স্বপ্ন, তাঁকে কি কেউ আটকাতে পারে! তাঁর ইচ্ছে, সাহস, মেধা, পরিশ্রম, প্রতিকূলতা কাটিয়ে সামনে চলার সুদৃঢ় বাসনা,ত্যাগ আর লেগে থাকার মানসিকতাই একদিন তাঁকে পৌছে দেয় তাঁর অভিষ্ট্য লক্ষ্যে। সবাই তখন বাহবা দিয়ে তাঁর প্রশংসায় হয়ে উঠে পঞ্চমুখ। কিন্তু সকলের কাছে তাঁর পেছনের ইতিহাস অজানাই থেকে যায় আজীবন। তাতে কি আসে যায়! সফলতা আর অধরাকে ধরার প্রতাশ্যা তাঁকে করে তুলে অনন্যা। ইচ্ছের অমোঘ শক্তি মানুষকে কেমন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়, শক্তি যোগায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, মানিকগঞ্জের ইসমাত জাহান অন্তরাকে না দেখলে তা জানা, যেনো অসর্ম্পূই রয়ে যায়।
ছেলেবেলার দুরন্তপণার দিনগুলো কাটিয়ে, লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সাংসারিক জীবনের শত প্রতিকূলতাকে হাসিমুখে জয় করে নেওয়া অন্তরা, নিজ পরিবার এবং শ্বশুরবাড়ীর সকলের নিকট অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ। দু’হাতে দশদিক সামলানো অন্তরা জীবনকে সাজিয়েছেন আপন রূপ-রস-গন্ধে। প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির দোলাচলে জীবনের দোদুল্যমান সংঘাতে কখনোই পিছু হটে না যাওয়াদের দলেরই একজন হয়ে, যেখানেই হাত রাখছেন, সেখানেই যেনো সোনা ফলাচ্ছেন তিনি। অনেকের জন্যই হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়। প্রতিনিয়তই সামনের পানে ধাবমান অন্তরার প্রদীপশিখার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠার গল্প এখন অনেকেরই মুখে মুখে। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে মার্কেটিং বিষয়ে স্নাতক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও এল এল বি সম্পন্নকরা ইশমাত জাহান অন্তরা, তাঁর মেধা-মননকে পারিবারিক জীবনে কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। বর্তমানে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে সবাই যখন ভয়ে কম্পমান, তখন ভয়কে জয় করেই যেনো জীবনের প্রয়োজনে, স্বপ্নের বাস্তব রূপায়নে হাত-গুটিয়ে ঘরে বসে না থেকে, অফিসের ব্যস্ত সময় কাটানোর পর নিজের অবসর সময়টুকুকে কাজে লাগিয়ে, নিসঃঙ্গ সময়কেই যেনো করে তুলেছেন আপন কাজের সঙ্গী। লকডাউনের সময়টুকুতে “ওয়াজিরা’স সুইট হ্যাভেন” নামে ঘরে বানানো বিভিন্ন ধরণের, বাহারী নামের সুস্বাদু-মজাদার কেক, হরেক রকম মুখরোচক ডেজার্ট তৈরী করা ছাড়াও, ২০১৭ সাল থেকে “জাহান’স পাকুড়া”নামে মচমচে স্ন্যাকস তৈরী করে অনলাইন মাধ্যম এবং ব্যক্তিগত চেনাজানা পরিসরে তা বাজারজাত করে, ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছেন। প্রতিনিয়তই গ্রাহকসন্তুষ্টি অর্জনে নিত্যনতুন খাবার প্রস্তুত করে চলেছেন তিনি। অন্তরা ২০১৪ সালে “বধূর গায়ে হলুদ গহনা” নামক অত্যন্ত সুদৃশ্য এবং রুচিশীল গায়ে হলুদের গহনা এবং পোশাক তৈরীর মধ্য দিয়ে মানিকগঞ্জসহ সারাদেশে সুপরিচিত লাভ করেন। ২০১৬ সালে নিজ বাসাতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “বাংলার বুনোন” নামক হস্ত ও কারু শিল্পের ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। মানিকগঞ্জ সদর থানাধীন গুলুটিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া ইসমাত জাহান অন্তরা, পারিবারিকভাবেই সততা আর সময় নিষ্ঠার হাতেখড়ি অর্জনের মাধ্যমে, নিজেকে তাঁর গ্রাহকদের কাছে করে তুলেছেন অতুলনীয়। অর্জন করেছেন ঈর্ষণীয় সফলতা। বাবা জামিলুর রহমান এবং মা মনোয়ারা বেগমের অত্যন্ত আদরের অন্তরাকে তাঁর আজকের অবস্থানে উঠে আসার পেছনে কার প্রেরণা রয়েছে, তা জানতে চাইলে তিনি জানান, “আমার স্বামী রফিকুল ইসলাম, আমার বাবা-মা, আমার ছোটবোন ইশরাত এবং ভগ্নিপতি কাইয়ুম হোসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে, হয়তো আমার পক্ষে এতটা পথ হেঁটে আসা সম্ভবপর হয়ে উঠতো না।” বাংলাদেশের নারীদের জন্য, বিশেষ করে গ্রামীণ কিংবা প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, “যতদিন পর্যন্ত নারীরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে, নিজেকে নারী না ভেবে একজন মানুষ ভাবতে শিখবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবেনা। নিজেদের মনের সংকীর্ণতা দূর করে তাদেরকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নইতো একজন মানুষকে জাগিয়ে রাখে সারারাত। বাস্তবে তার রূপ দিতে পরিশ্রম করতে হবে, সাধনা করতে হবে।” মাত্র দেড় বছর বয়সের একমাত্র শিশুকণ্যা ফাতিমা ইসলাম ওয়াজিরাকে বাসায় রেখে গিয়ে, কর্মক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতার জন্য প্রশংসিত হলেও, তাঁর মাতৃ-হৃদয়ের ভালোবাসার উষ্ণ প্রসবণ আন্দোলিত হয় এক গভীর মমতায়, যা অন্তরাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তবুও প্রাণোদ্যমে ছুটে চলেছেন তিনি। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠার প্রাণান্ত চেষ্টারত অন্তরা, পৌছে যেতে চায় আপন পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে স্বপ্নের সোনালী প্রান্তরে। মানিকগঞ্জ তথা বাংলাদেশের সুনামকে ছড়িয়ে দিতে চান প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান বিশ্ববাজারের প্রতিটি কোণায় কোণায়।